হারানোর বেদনা।

in hive-120823 •  3 months ago  (edited)

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারোকাতুহ।



জন্ম মৃত্যু নিয়েই আমাদের জীবন। কবি বলেন:-
"জন্মিলে মরিতে হবে অমর কে কথা কবে"।


লাইনটা আমাদের সবাইকে এটাই জানান দেয়, পৃথিবীতে কেউ চিরস্থায়ী নয়। প্রত্যেক প্রাণীকে একদিন না একদিন মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতেই হবে। এটাই সৃষ্টিকর্তার নিয়ম, যে নিয়মের বাইরে যাওয়ার মতো আমাদের কারুর সার্মথ্য নাই। কিন্তু, কিছু কিছু সময় হারানোর বেদনা গুলো অনেক বেশি কষ্টের হয়। যা তিলে তিলে জীবনটাকে শেষ করে দিতে থাকে। গত ২০২৩ সালের শেষ দিক থেকে আজ পর্যন্ত নিজের জীবনের সাথে যেন একটু বেশি হতাশা, দুশ্চিন্তা আর কষ্ট জরিয়ে গেছে। নানা সমস্যায় জর্জরিত জীবন। কোন দিকে যাব কি করব, কোনটা করলে ভালো হবে এটা বোঝার আগেই নতুন সমস্যা উকি দিয়ে জানান দেয় সে আসিতেছে।

পৃথিবীতে নাকি পিতা-মাতা আর সন্তানের সম্পর্কটা সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ। সন্তান যতটা খারাপই হোক মায়ের কাছে সে ভালো। সন্তানের কষ্টে মা যেন অস্থির হয়ে পরেন। সন্তানের একটু সুখের জন্য পিতা দিন রাত পরিশ্রম করতে থাকে। কি করলে সন্তানকে ভালো ভাবে বড় করা যাবে সে সব সময় চিন্তা করতে থাকে। যখন পিতা-মাতা বৃদ্ধ হয়ে যায়। হায়াত ফুরিয়ে আসতে থাকে তখন সন্তানেরাই তাদের দেখভাল করে। তাদের যাবতীয় খরচ বহন করতে থাকে। পিতা-মাতার ভালো হবে কিসে সেটা নিয়ে চিন্তা করে সব সময়। যদিও কিছু সন্তান থাকবে যা আবার পিতা-মাতাদেরকে দেখতে পারবে নাহ। সেটা আলাদা বিষয়। মানুষ একটা সন্তানের জন্য হাজার হাজার টাকা ডাক্তারকে দেয়। শত চেষ্টটা করে একটা সন্তান যাতে তাদের ঘরে আসে। বিশেষ করে মানুষের শেষ জীবনের দেখাশুনা করার জন্য হলেও সন্তান প্রয়োজন৷ মৃত্যুর পর তাকে দাফন করার জন্য হলেও একটা সন্তান দরকার এটা আমি মনে করি। কিন্তু কল্পনা করুন তো যদি দুনিয়াতে কারুর কোন সন্তানই না হয়। শত চেষ্টটা করেও যদি সৃষ্টিকর্তা তাদেরকে সন্তান দান না করেন, তাহলে শেষ বয়সে তাদের অবস্থা কেমন হবে। এটা নিশ্চয় আপনাদেরকে আর বলে বোঝাতে হবে না। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সমস্যায় পরতে হয়। সম্পদ থাকলেও অনেক সময় দেখাশুনার মতো লোক পাওয়া যায় না। আবার অনেক সময় দেখা যায় আত্মীয় স্বজনরাই দেখাশুনা করে।

যাই হোক, কথা অন্য দিকের। কথায় বলে মায়ের পরে না কি খালা মায়ের মতো ভালোবাসা আদর দিয়ে বোনের সন্তানকে মানুষ করে। এটা আমি আমার বাস্তব জীবনে সরাসরি উপলব্ধি করেছি। আমার মায়েরা ৫ বোন। মানে মা বাদে খালা মোট চার জন। তার মাঝে বেঁচে আছে তিনজন৷ আগেই একজন মারা গিয়েছে। বড় খালা, সেজো খালা, আর ছোট খালা আছে। এর মাঝে বড় খালা আর সেজো খালার কোনো সন্তান হয় নাই। অনেক চেষ্টটা করেছে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার নিয়ম তো কেই ভাঙতে পারে না। সন্তান না থাকায় ছোট বেলা থেকে তারা দুইজনই আমাকে সন্তানের মতো ভালোবেসে মানুষ করেছে। যদিও আমি আমাদের বাড়ীতেই থাকি, কিন্তু বড় হওয়ার পর থেকে তাদের সকল দেখভাল করার চেষ্টটা করি। যেকোনো প্রয়োজনে তারা কল দেয় আমাকে। আমি গিয়ে সকল কাজ করার চেষ্টটা করি। গত ৭/৮ বছর আগে আমার বড় খালু মারা যায়। তারপর থেকে বড় খালা একা হয়ে যায়। জা এর ছেলেরা প্রথম দিকে আমার খালাকে দেখত, কারণ আমার খালুর সকল সম্পত্তি তারা নিবে আর খালার নিজের নামেও জমি ছিল সেটা নেওয়ার জন্য মূলত তারা প্রথম দিকে খালাকে দেখতে থাকে, খরচ দিত। কিন্তু গত ৩ বছর আগে খালা হঠাৎ ব্রেন স্টোক করে, প্যারালাইসিস হয়ে যায়।

1000000538.jpg

আমিও আমার বড় খালা।

এরপর থেকে শুরু হয় নানা ধরনের সমস্যা। জা এর ছেলেরা খালাকে আর দেখেও না, কোন খরচও দেয় না। কিন্তু তাকে তো এভাবে ফেলে রাখালে হবে না। আমি আর ছোট খালা মিলে তাকে ডাক্তার দেখিয়ে সরাসরি আমাদের বাড়ী নিয়ে চলে আসলাম। কারণ সে তো হাটতে পারে না, আর তারবাড়ীতে তাকে দেখার মতো কেউ নাই। যেহেতু আমাকে বেশি ভালো বাসত তাই আমি তাকে আমাদের বাসায় নিয়ে আসছিলাম। অনেক চেষ্টা করে সৃষ্টিকর্তার দয়ায়, ডাক্তার দেখি খালা কয়েক মাসে অনেকটা সুস্থ হয়ে যায়।মোটামুটি হাটা চলা করতে পারত। নিজের খাওয়া দাওয়া নিজেই করতে পারত। কিন্তু কোনো কাজ করতে পারত না। এ অবস্থায় তাকে এখন দেখভাল করতে হবে। কিন্তু করবে কে তার তো কোনো সন্তান নাই। আমি আমাদের বাড়ীতে রাখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমার মা অসুস্থ হওয়ায় রাখতে পারি নাই। পরে আমার ছোট খালাদের বাড়ী পাঠিয়ে দিয়েছি। যেহেতু তারও কোন সন্তান না থাকায় সে খালাকে ভালে ভাবে দেখাশুনা করতে পারবে। আর সকল ধরনের কাজ, ডাক্তার দেখানো ঔষুধ কেনা খেজ নেওয়স সব আমি করতাম।

এভাবেই চলতেছি, আমার বড় খালা আমি ছাড়া কিছু বুঝত না। যা করবে আমাকে যাওয়াই লাগবে। সকল কথা আমার সাথে শেয়ার করত। আমাকে আব্বা বলে ডাকত। কল দিলেই বলে উঠত আব্বা কেমন আছো. আমিও চেষ্টটা করতাম সব সময় তাদেরকে খুশি রাখতে। কিন্তু ঈদের ২ দিন আগে ২৮ রমজান (২৯ শে মার্চ), আমার জীবনে যেন এক কালো মেঘ ঘনিয়ে এলো। আমি মসজিদে ইতেকাফে ছিলাম। এজন্য ফোন বাড়িতে রেখে গিয়েছিলাম। ২৭ রমজান শুক্রবার হঠাৎ সেহেরির সময় আমার আব্বু মসজিদে খাবার দিয়ে আসতে গিয়ে আমার বললো তোর বড় খালা অসুস্থ ডাক্তার দেখাতে হবে ছোট খালুর সাথে কথা বলত বলছে। আমি তখনই বাড়ী থেকে ফোনটা এনে খালুর সাথে কথা বলে জানতে পারলাম বড় খালা খুবই অসুস্থ হঠাৎ তার শরীর ফুলে গিয়েছে আর কিছু খেতে পারছে না। গত তিন দিন ধরে এমন হচ্ছে।

1675700445785.jpg
গ্রুপ ছবি

আমি রাতেই আমার পরিচিত এক ডাক্তার যাকে দিয়ে খালার চিকিৎসা করায়। তার এসিস্ট্যান্ট এর কাছে কল দিয়ে সিরিয়াল দিয়ে দিলাম। এরপর শুক্রবার আমার বড় ভাইকে দিয়ে ডাক্তারের কাছে পাঠালাম। আমি যেহেতু ইতেকাফে ছিলাম এজন্য মসজিদ থেকে বের হতে পারি নাই। সারা দিন মসজিদে বসেই অনেকটা নিয়ম না মেনেই কলে কথা বলে খালার খোজ নিয়েছিলাম। ডাক্তার দেখিয়ে এসে খালা বাড়ী চলে আসে। এমনিতে প্রতিদিনই তার সাথে আমার কথা হতো। কিন্তু গত ৭/৮ দিন মসজিদে থাকায় কারুর সাথে কোন কথা হয় নাই। শুক্রবার সন্ধায় ডাক্তার দেখানোর পর জানতে পারলাম খালার নতুন করে আবার কিডনিতে সমস্যা ধরা পরছে। যার ফলে কিছু খেতে পারছিল না আর ফুলে যাচ্ছিল। ডাক্তার ঔষুধ দিলে সেগুলো কিনে আমার ছোট খালা বাড়ী নিয়ে গিয়েছিল। আমি সন্ধার সময় বড় খালার সাথে কথা বলার জন্য কল দিলাম, কিন্তু ছোট খালা বাসায় না থাকার কারণে কথা বলতে পারি নাই। ভাবলাম সাহরীর সময় কথা বলবনে। মনটা যেন কেমন করতেছিল কথা না বলতে পেরে। টেনশনে ভালো না লাগায় শুক্রবার তারাবিহ আদায় করে কিছুটা সময় পরই ঘুমিয়ে পরেছিলাম।

ঘড়িতে এলাম দিয়ে আমি ঘুমায়, যাতে সাহরির সময় উঠতে পারি। হঠাৎ রাতে কে যেন মসজিদের দরজা জোরে জোরে কড়া নাড়ছিল।আমি ভেবেছি হয়ত আব্বু খাবার দিতে আসছে,, সাহরীর সময় হয়ে গিয়েছে। তারাতারি উঠে দরজা খুলে আব্বুর হাতের দিকে তাকিয়ে দেখি খাবারের কোন ব্যাগ নাই। জিগাস করলাম খাবার কোথায়। তখন আব্বু বলে, তোমার খালা তো আর নাই। কথাটা শোনার পর, আমি যেন নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারতে ছিলাম না। চোখ দিয়ে অঝরে পানি পরতে লাগল। ৮ টা দিন একটু কথাও বলি নাই। ১০ দিন না শেষ হলে মসজিদ থেকে বের হওয়া যায় না। কিন্তু খালা মারা যাওয়ায় আমি নিয়ম না মেনে ইতেকাফ ভঙ্গ করে বাইরে চলে আসি। এতো ভালেবাসার মানুষ বজ দুনিয়া ছেড়ে চলে যাচ্ছে আর আমি বসে থাকব এটা হয় না। বুকে কষ্ট নিয়ে সেই রাতেই ছোট খালাদের বাড়ী চলে গেলাম। গিয়ে দেখি, খালাকে নিচে শুয়িয়ে রাখা হয়েছে। খালার মৃত দেখটা দেখে আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারলাম না। কান্নায় ভেঙে পরেছিলাম। আমাকে সবাই শান্তনা দিচ্ছিল। কিছু সময় পর বিভিন্ন পাশের বাড়ীর মানুষেরা এসে আমাকে বলতে লাগল, মৃত্যুর আগে খালা শুধু আমার নামই বলেছে। সব সময় যে কোন কাজেই বলত রাসেল আসুক, তারপর করব। এমন কি শুক্রবার ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাবে তাও বার বার বলেছে রাসেলকে ছাড়া আমি ডাক্তারের কাছে যাব না। কিন্তু আমি তো বের হতে পারছিলাম না।এজন্য পরে অনেকটা জোর করেই ভাইয়ের সাথে ডাক্তারের কাছে পাঠানো হয়।

ডাক্তার দেখিয়ে, রাতে ঔষুধ খেয়ে খালা ঘুমিয়েছিল। রাত ১১ টার দিকে আমার ছোট খালা বড় খালার ঘরে গিয়ে দেখে আসে সে ঘুমিয়ে আছে, তখনও বেঁচে ছিল। হঠাৎ সাহরীর সময় কোনো সারা না পেয়ে ছোট খালা ডাকতে গিয়ে দেখে খালা মারা গিয়েছে।😞😞 তারপর সবাইকে জানানো শুরু হলো। কথাটা যখন শুনেছিলাম, তখন যেন একটা পাহাড় ভেঙে পরেছিল বুকের মাঝে। যে মানুষটা আমাকে সন্তানের মতো ভালোবাসে, ৮ টা দিন তার মুখে একটু কথাও শুনতে পারলাম না। এই কষ্টেই নিজেকে দোষী মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল কিছু যেন আমাকে বলে যেত পারত। ঈদের এই খুশির মুহূর্তে জীবনে নেমে আসল দুঃখের ঝড়না৷ শনিবার দুপুর ১২ টার পর খালার দাফন সম্পূর্ণ হয়। তারপর আমি আবারও বাড়ী এসে মসজিদে অবস্থান করি। সত্যি বলতে,, আমার জীবনটা যে কেন এমন, একটা ধাক্কা সামলাতে না সামলাতেই জীবনে নতুন ঝড় চলে আসে। জীবনের কোনো কিছুই আর ভালো লাগে না। কিন্তু সবকিছুর মাঝে, জীবনের বাস্তবতাটাকে তো মেনে নিতেই হবে। সেটা যত কষ্টই হোক। সেদিনের পর থেকে ঈদটাও আনন্দে তেমন কাটে নাই। সব সময় খালার কথাই মনে পরে। তার সেই ডাক যেন অন্তরে সব সময় বেজে ওঠে। আমার খালার জন্য আপনারা সবাই দোয়া করবেন। যাতে আল্লাহ তায়ালা তার জীবনের সকল গুনাহগুলো মাফ করে দিয়ে তাকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করেন (আমিন).

লেখাটা লেখতে গিয়ে বুকটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছিল। তবুও খালার স্মৃতি হিসেবে পোষ্ট রয়ে যাবে। সবাই ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন। আবারও দেখা হবে আমার নতুন কোনো পোষ্ট নিয়ে।

1000007009.png

1000007010.gif

সবাইকে অনেক ধন্যবাদ আজকের পোষ্টটা পড়ার জন্য।

Authors get paid when people like you upvote their post.
If you enjoyed what you read here, create your account today and start earning FREE STEEM!
Sort Order:  

Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.

Loading...

পরিবারের যে কোন প্রিয়জনকে হারানোর যন্ত্রণা সত্যিই খুব বেদনাদায়ক। তার সাথে কাটানো পুরনো স্মৃতি যেন কিছুতেই আমরা ভুলে উঠতে পারি না। প্রিয়জনে রাই খুব তাড়াতাড়ি আমাদের ছেড়ে চলে যায়। আপনি আপনার মাসি সমস্ত দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করেছেন। নিজের ছেলের মত তার সমস্ত কিছু পূরণ করেছেন তার দেখাশোনা করা। তবে এই পৃথিবীতে সকলেই যখন জন্মেছি তখন সকলকেই এই পৃথিবী ছেড়ে একদিন না একদিন চলে যেতেই হবে সমস্ত মায়া ত্যাগ করে। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, আপনার মাসি আত্মার শান্তি কামনা হোক। সুন্দর পোস্টটি শেয়ার করার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

অনেক ধন্যবাদ এতো সুন্দর একটা মন্তব্যের জন্য।

শুধুমাত্র আপনার খালাম্মা নয় এই পৃথিবীতে এখন অনেক মানুষ আছে যারা কিনা অকালে এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যায় যাদেরকে দেখার মত কোন মানুষ থাকে না তার পরেও বলবো আপনি আপনার নিজের সাধ্যমত চেষ্টা করেছেন ওই মানুষটাকে সাহায্য করার জন্য এমন মন মানসিকতার মানুষ ও বর্তমান সময়ে পাওয়া যায় না যাইহোক অসংখ্য ধন্যবাদ হারানোর বেদনা তারাই বুঝতে পারে যারা একবার আপন মানুষ হারিয়ে ফেলেছে।

অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।